জলবায়ু কূটনীতিতে জাতিসংঘ কতটা সফল 

 ফারিহা জেসমিন  
১৬ নভেম্বর ২০২২, ০২:৩১ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

কোভিডপরবর্তী আর্থিক সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৮ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বে আফ্রো-এশিয়ান দেশ মিসরের পর্যটন নগরী শারম-আল-শেখ শহরে জাতিসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৭তম বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭)। এর আগে এক এক করে ২৬টি জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেলেও বিশ্ব জলবায়ু পরিস্থিতিতে আসেনি তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন। 

বিশ্বজুড়ে উপকূলীয় দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো শিল্পোন্নত দেশসমূহের অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে মারাত্মকভাবে ভুগছে। বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা, উড়িয়ে দেওয়া যায় না আন্তর্জাতিক সংঘাতের সম্ভাবনাও। তা হলে কি প্রশ্ন উঠে জাতিসংঘ এ জলবায়ু কূটনীতিতে ঠিক কতটা সফল?  কেন প্রতি বছর জাতিসংঘের জলবায়ু কূটনীতির ব্যানারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে না এবং দরিদ্র দেশগুলো পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে নানাবিধ দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে?  

যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রসমূহ সফল কূটনীতির জোরে সমাধান করেছে বিশ্বের নানান অমীমাংসিত ইস্যু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী মার্শাল প্ল্যান থেকে শুরু করে ইউরোপের অর্থনীতিক পুনর্গঠন, ৯/১১-এর পরবর্তী আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার গঠন থেকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা অন্যান্য বৈশ্বিক রেজিমের যাত্রা, জাতিসংঘের কনভেনশনের মাধ্যমে চুক্তি আইন, যুদ্ধসংক্রান্ত আইন, সমুদ্র আইন এ সব কিছুর পেছনেই রয়েছে সফল কূটনীতির ইতিহাস। নিঃসন্দেহে জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত সব ধরনের আলাপ-আলোচনা বা কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক সংস্থাটির কূটনীতির অংশ। 

ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ জাতিসংঘের একটি রেজিম বা শাসনব্যবস্থা, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকগুলো মোকাবিলায় রাষ্ট্রগুলোকে এক করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের এই প্লাটফর্মটি আজ পর্যন্ত আয়োজন করেছে ২৬টি জলবায়ু সম্মেলন, যা পরিচিত কনফারেন্স অব দ্য পারটিজ বা কপ নামে। গত ৬ নভেম্বর মিসরে শুরু হয়েছে ২৭তম কপ বা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ, ১৯৮ দেশের ৪৫ হাজার প্রতিনিধি মিলিয়ে একটি বিশাল জলবায়ুবিষয়ক আলোচনার আসর বসেছে মিসরের শারম-আল-শেখে। সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বের বড় বড় নেতা যেমন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জার্মানির ওলাফ শলৎস, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান। উরসুলা ফন ডার লায়িন এ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাস্তবিক, এসব দেশই প্রধানত অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনে ভুমিকা রাখছে। 

বিগত কয়েক দশক ধরেই সরকারগুলো এক হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে জোর  প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রগুলোকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আলোচনার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রথম কপ সম্মেলন হয় ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে। এরও আগে ১৯৭২ সালের সুইডেনে অনুষ্ঠিত স্টকহোম কনফারেন্স বা প্রথম আর্থ সামিট, ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আর্থ সামিট, এসবের মাধ্যমে আরও অন্তত ৫০ বছর আগে থেকেই শুরু হয় রাষ্ট্রগুলোর জলবায়ু বিষয়ক আলাপ-আলোচনা প্রক্রিয়া। সাধারণত, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর জন্য দায়ী কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিসমূহ সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া এবং এসবের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনাই হলো জলবায়ু সম্মেলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। 

১৯৯৭ সালের কিয়েটো প্রটোকল এবং ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি জাতিসংঘের বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের একটি সফল দিক, যেখানে রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে সম্মত হয়েছে। তার পরও বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণতা, ঝুঁকির মুখে সমুদ্র উপকূলীয় উন্নয়নশীল বা  দরিদ্র দেশগুলো।  

প্রথমদিকের জলবায়ু সম্মেলনগুলো মিটিগেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে বাঁধা দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিলেও পরবর্তীতে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন নিয়ে আলোচনা হয়। তারও পরে সাম্প্রতিক সম্মেলনগুলোতে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিং সমঝোতার মুখ্য বিষয় হিসেবে সম্মেলনে জায়গা করে নেয়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা এবং সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ এর কারণে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পাইওনিয়ারের ভুমিকা পালন করে। 

২০০৭ এ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ১৩তম কপএ, ২০১০-এ ১৬তম কপএ, ২০১২-এ দোহায় অনুষ্ঠিত ১৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিং নিয়ে ব্যাপক আলাপ- আলোচনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তে  পৌঁছান বিশ্ব নেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলা করে সেটি কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার জন্য ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম (ডব্লিউআইএম) ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ নামক একটি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একমত হন তারা। পরে ২০১৫ সালে ১৯তম জলবায়ু আলোচনায় প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৮-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনার একটি কার্যকর ধারণা দেয়। কিন্তু তার পরের সম্মেলনগুলোতে উন্নত এবং কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর রোক্ষ অনীহার কারণে এ আলোচনা আর বেশি দূর আগাতে পারেনি। 

গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে হয়ে যাওয়া ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লস অ্যাজ ফাইন্যান্সিং বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়নের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো গ্রহণ করেনি, কিন্তু ক্ষতি মোকাবিলায় দুই বছর সময়সীমার গ্লাসগো ডায়ালগ চালু করেছে। যার লক্ষ্য ক্ষতি কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার উপায় বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা নিশ্চিতের জন্য সান্তিয়াগো নেটওয়ার্কে অর্থায়ন করার বিষয়ে আলোচনা।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মিসরে চলতি জলবায়ু সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু সংকটের সঙ্গে লড়তে সুদূরপ্রসারী 'ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট' নামক নতুন আইন পাসের মাধ্যমে জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলায়  সবচে  বড় পদক্ষেপটি নিয়েছে।এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে দেওয়া গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন ৪০ শতাংশ কমে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণকারী চীন তাইওয়ান ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার হাত ফিরিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে অস্ত্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইইউ, ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলো ও কার্বন নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হারে ( ৪০-৪৫ শতাংশ) কমাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের কর্মকাণ্ড তার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমেরিকার মতো দেশ ক্লাইমেট ফান্ডে তার যে পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা  দেওয়ার কথা ছিল, তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা জলবায়ু প্রশ্নে উদ্বেগ বাড়িয়েছে  ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধপরবর্তী বিশ্বকে নিরাপদ এবং শান্তিময় রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাতিসংঘ জলবায়ু কূটনীতিতে কতটা সফল তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে আরও বিশদ আলোচনা আবশ্যক।  তবে বলা যায়, জাতিসংঘ এই তীব্র সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও বিশ্ব শক্তিগুলোকে জলবায়ু প্রশ্নে এক করতে পেরেছে, যার ফল হলো প্রতি বছরের কপ সম্মেলনগুলো। এই প্লাটফর্মে রাষ্ট্র এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনার টেবিলে বসছে , বারগেইন করছে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এটাও জাতিসংঘের একটি সাফল্য বলে আমি মনে করি । তবে  জলবায়ু ইস্যুতে  জাতিসংঘের পুরোপুরি সফল হতো যদি কিছু বাধ্যতামুলক মেকানিজম জাতিসংঘ চালু করতে পারতো, যা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থাটির একটি বাস্তব এবং পুরনো  দুর্বলতা। পরিবেশ ঠিক রাখার কার্বন নিঃসরণ কমানো, হয়ে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় পদেক্ষপ বাস্তবায়নসহ সব ধরনের শর্ত মেনে নিতে রাষ্ট্রগুলোকে স্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করা একটি কার্যকরী সমাধান বলে আমি মনে করি। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক 
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন